কক্সবাজার সম্পর্কে বিস্তারিত
কক্সবাজার
চট্টগ্রাম বিভাগের একটি জেলা। চট্টগ্রাম থেকে ১৫৯ কি.মি. দক্ষিণ পূর্বে বঙ্গোপসাগর- এর তীরে এই জেলাটি অবস্থিত। ভৌগোলিক অবস্থান ২১°৩৫′০″উত্তর ৯২°০১′০ পূর্ব″। এই জেলার বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ৩,৩৭৮ মিলিমিটার ।
সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা: জুন মাসে, ৩৯.৫০ সেলসিয়াস। সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা : জানুয়ারী মাসে, ১১.৮০ সেলসিয়াস ।
বার্ষিক গড় আর্দ্রতা : ৮৩ শতাংশ।
জেলার প্রধান নদনদী: মাতামুহুরী, বাঁকখালী, রেজু, কোহালিয়া ও নাফ।
উদ্ভিদ : কক্সবাজার জেলা উদ্ভিদ সম্পদে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সমুদ্র উপকূলের লবণাক্ত ভূমিতে ঝাউ, কেয়া গাছ জন্মে। এছাড়া পাহাড়ে রয়েছে গর্জন, শাল, সেগুন, মেহগনি
গাছের মতো মূল্যবান গাছ।
প্রধান দ্বীপ: মহেশখালী, কুতুবদিয়া, মাতারবাড়ী-ধলঘাটা, সোনাদিয়া ও সেন্টমার্টিন।
উপজেলার সংখ্যা ৮টি। এগুলি হলো— উখিয়া, কক্সবাজার সদর, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, টেকনাফ, পেকুয়া, মহেশখালী এবং রামু।
ইউনিয়নের সংখ্যা: ৭১ টি
গ্রাম: ৯৯২ টি।
জাতীয় সংসদের আসন সংখ্যা : ০৪টি :
কক্সবাজার- ১ (চকরিয়া-পেকুয়া),
কক্সবাজার- ২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া)
কক্সবাজার- ৩ (কক্সবাজার সদর-রামু )
কক্সবাজার- ৪ (টেকনাফ-উখিয়া )
এই জেলার উত্তরে চট্টগ্রাম জেলা, পূর্বে বান্দরবান জেলা ও বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমানা বিভক্তকারী নাফ নদী এবং মায়ানমার, দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর। এ জেলার আয়তন ২৪৯১.৮৬ বর্গ কি.মি.। এর জেলায় রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ বালুকাময় সমুদ্র সৈকত। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১২০ কিলোমিটার। এই জেলায় রয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন।
কক্সবাজারের অরণ্য-ঢাকা পার্বত্যভূমির জন্য একসময় এটি একটি দুর্গম এলাকা ছিল। এই কারণে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সাথে এই অঞ্চলের যোগাযোগ সহজতর ছিল না। একসময় আরাকানের শাসক, মগ, মোগল, বাঙালি, চাকমা ইত্যাদি রাজশক্তির দ্বন্দ্ব ছিল এই জেলার অধিকার নিয়ে। এছাড়া পোর্তুগিজ দস্যুদের অনুপ্রবেশের জন্যও এই অঞ্চল অনেকটা ভীতিপ্রদ এলাকায় পরিণত হয়েছিল। এই সময় এই অঞ্চলের নাম ছিল বাকোলি।
আরাকানের রাজারা চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার অঞ্চল খ্রিষ্টীয় ৯ম শতাব্দীতে শাসন করতো। মোগলরা ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে এই অঞ্চল তাদের অধিকারে আনে। কথিত আছে, মোগল আমালের বাংলার শাসন কর্তা শাহ সুজা আরাকান প্রদেশে যাওয়ার সময় এই পথ ধরে গিয়েছিলেন এবং এই অঞ্চলের পাহাড়, অরণ্য ও সাগরের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এ্ই কারণে তিনি একটি এখানে অবস্থান নেন।। তাঁর সাথের এক হাজার পালকি (ঢুলি) এই অঞ্চলে অবস্থান নেয়। এই হাজার ঢুলির নামানুসারে এই অঞ্চলের একটি স্থানের নাম ডুলাহাজারা হয়। উল্লেখ্য এটি বর্তমানে চকরিয়া উপজেলার একটি ইউনিয়ন।
মোগল আমলের এই এলাকার নাম ছিল এই সময় কক্সবাজারের নাম ছিল পালোংকি। মোগলদের পরে ক্রমে ক্রমে ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী এই অঞ্চল অধিকার করে। ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী এই অঞ্চলের সুপারেন্টেন্ড হিসাবে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স (Captain Hiram Cox ) নামক একজন সেনা-কর্মাকর্তাকে নিয়োগ দেয়।
ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘অধ্যাদেশ ১৭৭৩’-এর সূত্রে ওয়ারেন হেস্টিং বঙ্গদেশের গভর্ণর হিসেবে নিয়োগ পান। এই সময় তিনি কোম্পানির বঙ্গদেশের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তের পালোংকিতে সুপারেন্টেন্টট হিসেবে নিয়োগ পান। উল্লেখ্য, এই সময় কক্সবাজার ও তৎসংলগ্ন কিছু অঞ্চলের ছিল নাম ছিল পালংকী। স্থানীয় ভাষায় এই অঞ্চলটি পানোয়া নামেও পরিচিতি ছিল। উল্লেখ্য পানোয়া শব্দের অর্থ হলো- পীত নদী।
১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বার্মার রাজা ভোদপায়া আরাকান রাজ্য আক্রমণ করেন। এই সময় হাজার হাজার আরাকানী পালিয়ে বাঁকখালি নদীর তীরবর্তী রামু এবং পেঙ্গোয়া অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিল। এই সময় ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে হিরাম কক্স শরনার্থীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি প্রতি পরিবারকে ২.৪ একর জমি এবং ছয় মাসের খাদ্যসামগ্রি প্রদান করা হয়েছিল। এ সময় ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স রাখাইন অধ্যুষিত এলাকায় একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানীয়দের কাছে এটি কক্স সাহেবের বাজার পরিচিতি লাভ জরেছিল। পরে জায়গাটির নাম কক্সবাজার। এই কাজ শেষ করার পূর্বেই তিনি ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর বাঁকখালির তীরে হিরাম কক্সকে সমাহিত করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের সে সমাধি বাঁকখালি নদীর ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
একসময় ইংরেজ প্রশাসন পালঙ্কীর পরিবর্তে এই অঞ্চলকে Cox’s Bazar নামে উল্লেখ করা শুরু করে। পড়ে স্থানীয় লোকেরা ইংরেজদের অনুকরণে একে কক্সসবাজার ডাকা শুরু করে। ধীরে ধীরে এই নামটিও পরিবর্তিত হয়ে কক্সবাজার-এ পরিণত হয়েছে। অবশ্য ইংরেজিতে একে এখনও Cox’s Bazar বলা হয়।
ব্রিটিশ শাসনামলে এখানে থানা স্থাপিত হয়। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে কক্সবাজারকে চট্টগ্রাম জেলার মুহকুমায় পরিণত করা হয়। ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারিতে ব্রিটিশ সরকার ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে শাসনভার গ্রহণ করে। এই সময় ব্রিটিশ সরকার কক্সবাজারকে বঙ্গ নামক প্রদেশের (Bengal Province) একটি জেলা হিসাবে ঘোষণা দেয়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত বিভাজনের সময় কক্সবাজার পূর্ব-পাকিস্তানের অংশে পড়ে। তখন কক্সবাজারকে চট্টগ্রামকে মহকুমা করা হয়। ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গানবোটের জন্য অস্থায়ীভাবে একটি ছোটো মাপের বন্দর তৈরি করা হয়েছিল। এই সময় পাকস্তানি সৈন্যরা বহু স্থানীয় লোককে হত্যা করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে একটি টাউন কমিটি করা হয়। এবং ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে কক্সবাজারে পুনরায় পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৪ সালে কক্সবাজার মহুকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে কক্সবাজার পৌরসভাকে বি-গ্রেডে উন্নীত করা হয়। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে এখানে মেরিন ফিশারিজ এ্যান্ড টেকনোলোজি স্টেশন (MFTS) স্থাপন করা হয়।
ভূতাত্তিকদের মতে, প্রায় সত্তর হাজার বছর আগে সৃষ্ঠি হয়েছে। এ জেলার মৃত্তিকার পযার্লোচনায় দেখা যায় উপরের স্তরে কাদা এবং পাহাড়ী বেলেমাটি রয়েছে। এ স্তর ৫০ ফুট হতে ১৫০ ফুট পযর্ন্ত গভীর। এর পরবর্তী স্তরে শুষ্ক পলির সাথে মধ্যমাকৃতির মোটা বালিকণা রয়েছে। সারিবদ্ধভাবে মাটির পাহাড়ে এই জেলা পরিপূর্ণ। সেই সাথে রয়েছে নানা রকমের গাছ গাছালি।
কক্সবাজার জেলার পর্যটন অঞ্চল
সমুদ্র সৈকত : পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকত দৈর্ঘ্য ১১২ কিঃমিঃ।
হিমছড়ি: কক্সবাজার শহর থেকে ৯ কিঃমিঃ দক্ষিণে অবস্থিত পাহাড়, সমুদ্র ও প্রাকৃতিক ঝরণা।
অগ্গ্মেধা ক্যাং : কক্সবাজার শহরের গোলদিঘীর পাড়ে, রাখাইন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সংস্কৃতি ও উপাসনালয় ।
আদিনাথ মন্দির : মহেশখালী উপজেলা সদরে অবস্থিত শিব মন্দির।
সোনাদিয়া দ্বীপ: কক্সবাজার শহর থেকে পশ্চিমে এবং মহেশখালী দ্বীপের দক্ষিণে অবস্থিত সমুদ্র বেষ্টিত দ্বীপ ।
রাম কোট : রামু থানা সদর থেকে ৪কিঃমিঃ দুরে অবস্থিত বৌদ্ধ বিহার ও সম্রাট অশোক কর্তৃক নির্মিত বৌদ্ধ মূর্তি ।
লামার পাড়া ক্যাং: রামু থেকে ৩ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত কারুকার্যমণ্ডিত বৌদ্ধ মন্দির।
ইনানী সৈকত : উখিয়া থানার ৬ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত সমুদ্র সৈকত।
প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন : বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ।
মাথিনের কূপ: টেকনাফ থানা সদরে অবস্থিত রাখাইন রমনী এবং বাঙালি ধীরাজ ভট্টাচর্যের শাশ্বত প্রেমের স্মৃতি বিজড়িত স্থান ।
বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্ক: চকরিয়া উপজেলা থেকে ৫ কিঃমিঃ দক্ষিণে ডুলাহাজারা নামক স্থানে অবস্থিত
৯০০হেক্টর এলাকা জুড়ে সংরক্ষিত বনভূমি ও বন্য জীবজন্তুর অভয়ারণ্য।
কুদুম গুহা : হোয়াইক্যং ইউনিয়নের বাজার থেকে ৪ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত প্রাকৃতিক গুহা।